Thursday, September 25

আবার আসিব ফিরে - জীবনানন্দ দাশ


আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হবোÑকিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারাদিন কেটে যাবে কলমির গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ খেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা বায়; রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।

নারী - কাজী নজরুল ইসলাম


সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বের যা-কিছুমহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বেযা-কিছুএল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধূদেরত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন্ রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-¯তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোনো কালে একা হয়কো জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।
   সে-যুগ হয়েছে বাসি,  যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।
নর যদি রাখে নারীর বন্দি, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।
   যুগের ধর্ম এই - পীড়ন করিলে সে-পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।

পাছে লোকে কিছুবলে - কামিনী রায়


করিতে পারি না কাজ, 
সদা ভয়, সদা লাজ
সংশয়ে সঙ্কল্প সদা টলে,
পাছে লোকে কিছুবলে।
আড়ালে আড়ালে থাকি,
নীরবে আপনা ঢাকি,
সম্মুখে চরণ নাহি চলে,
পাছে লোকে কিছুবলে।
হৃদয়ে বুদবুদ মতো,
উঠে শুভ্র চিšতা কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে
পাছে লোকে কিছুবলে।
কাঁদে প্রাণ সবে, আঁখি
যবুতনে শুষ্ক রাখি
নিরমল নয়নের জলে
পাছে লোকে কিছুবলে।
একটি স্নেহের কথা
প্রশমিতে পারে ব্যথা
চলে যাই উপেক্ষায় ছলে
পাছে লোকে কিছুবলে।
মহৎ উদ্দেশ্যে যবে
এক সাথে মিলে সবে
পারি না মিলিতে সেই দলে
পাছে লোকে কিছুবলে।
বিধাতা দিছেন প্রাণ
থাকি সদা ম্রিয়মাণ
শক্তি মরে ভীতির কবলে
পাছে লোকে কিছুবলে।

দুই বিঘা জমি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।
কহিলাম আমি, তুমি ভূ¯^ামী, ভূ মির অšত নাই।
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই।
শুনি রাজা কহে, বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থ ও দিঘে সমান হইবে টানাÑ
ওটা দিতে হবে। কহিলাম তবে ব¶ে জুড়িয়া পাণি
সজল চ¶ে, করুন র¶ে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সেমাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি ল²ীছাড়া!
আঁখি করি লাল রাজা ¶ণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্র‚র হাসি হেসে, আচ্ছা, সে দেখা যাবে।

বঙ্গভূমির প্রতি - মাইকেল মধুসূদন দত্ত

রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।
সাধিতে মনের সাধু,
ঘটে যদি পরমাদ,
মধুহীন করোও না গো  তব মনঃকোকনদে।
প্রবাসে, দৈবের বশে,
জীব-তারা যদি খসে
এ দেহ-আকাশ হতে,  নাহি খেদ তাহে।
জন্মিলে মরিতে হবে,
অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর,  হায় রে, জীবন-নদে?
কিন্তু যদি রাখ মনে,
নাহি, মা, ডরি শমনে;
ম¶িকাও গলে না গো  পড়িলে অমৃত-হ্রদে।
সেই ধন্য নরকূলে,
লোকে যারে নাহি ভুলে,
মনের মন্দিরে সদ  সেবে সর্বজন;-
কিন্তু কোন গুণ আছে,
যাচিব যে তব কাছে,
হেন অমরতা আমি,  কহ, গো, শ্যামা জন্ম দে!
তবে যদি দয়া কর,
ভুল দোষ, গুণ, ধর
অমর করিয়া বর দেহ দাসে, সুবরদে!
ফুটি যেন স্মৃতি-জলে,
মানসে, মা, যথা ফলে
মধুময় তামরস কী বসšত, কী শরদে! রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।
সাধিতে মনের সাধু,
ঘটে যদি পরমাদ,
মধুহীন করোও না গো  তব মনঃকোকনদে।
প্রবাসে, দৈবের বশে,
জীব-তারা যদি খসে
এ দেহ-আকাশ হতে,  নাহি খেদ তাহে।
জন্মিলে মরিতে হবে,
অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর,  হায় রে, জীবন-নদে?
কিন্তু যদি রাখ মনে,
নাহি, মা, ডরি শমনে;
মক্ষিকাও গলে না গো  পড়িলে অমৃত-হ্রদে।
সেই ধন্য নরকূলে,
লোকে যারে নাহি ভুলে,
মনের মন্দিরে সদ  সেবে সর্বজন;-
কিন্তু কোন গুণ আছে,
যাচিব যে তব কাছে,
হেন অমরতা আমি,  কহ, গো, শ্যামা জন্ম দে!
তবে যদি দয়া কর,
ভুল দোষ, গুণ, ধর
অমর করিয়া বর দেহ দাসে, সুবরদে!
ফুটি যেন স্মৃতি-জলে,
মানসে, মা, যথা ফলে
মধুময় তামরস কী বসšত, কী শরদে!